আবদুর রহমান তাঁর নাম। বাইসাইকেলে চড়ে গ্রামের মেঠোপথ পাড়ি দেন। সঙ্গী তার বৃক্ষ। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে চারা বিক্রি করাই তার পেশা।
দিনশেষে কোনো এক বাজারে অবস্থান নেন তিনি। লক্ষ্য একটাই স্বল্প মূল্যে মানুষের হাতে গাছের চারা পৌঁছে দেয়া। মানুষকে বৃক্ষরোপনে উদ্বুদ্ধ করা। ভ্রাম্যমান এ বিক্রেতার নাম আবদুর রহমান।
স্থানীয়রা তাকে কখনো বৃক্ষপ্রেমী কখনো বৃক্ষবন্ধু বলে ডাকেন। তার বাড়ি কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের হাসিমপুর গ্রামে। প্রবাস ফেরত ত্রিশোর্ধ এই যুবক তিন বছর থেকে বাইসাইকেলে করে গাছ নিয়ে ছুটে চলেছেন মানুষের কাছে। স্বল্প মূল্যে বিক্রি করছেন বনজ, ফলজ ও ঔষধী গাছ।
জানা যায়, আবদুর রহমান প্রতিদিন কুলাউড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গাছ নিয়ে যান। গড়ে ৩০-৪০ কি.মি. এলাকা প্রতিদিন ঘুরেন। ফেরার পথে অবিক্রিত গাছগুলো স্থানীয় কোনো হাট-বাজারে বিক্রি করেন।
অন্য কোনো পেশায় নিজেকে স¤পৃক্ত না করে গাছ বিক্রি করাটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করেছেন আবদুর রহমান। তার মতে মানুষ অনেক সময় গাছের চারা খোঁজে এনে রোপন করতে আগ্রহী হন না , হাতের কাছে পৌঁছে দিলে মানুষ তা ক্রয় করে। ন্যায্য বা কমদামেও অনেক সময় গাছ বিক্রি করেন তিনি।
আবদুর রহমানের মতে দাম মূখ্য নয়, সবুজায়ন হোক প্রতিটি বাড়ি। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকুক প্রতিটি এলাকায়।
গত ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দিন একটি এলাকায় গাছ বিক্রিকালে কথা হয় তাঁর সাথে।
তিনি জানান, চ্যালেঞ্জিং এ পেশায় তার আসার পেছনের গল্পটা একটু অন্যরকম।
প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। কর্মধা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। ভাগ্য বদলের আশায় পাড়ি দেই সৌদি আরবে। জেদ্দায় একটি কো¤পানিতে প্রথমে কন্সট্রাকশনের কাজ করি। পরবর্তীতে ফোরম্যানসহ একাধিক দায়িত্ব পালন করি। অনেক অর্থ রোজগার করেছি। একপর্যায়ে দীর্ঘদিন ক¤িপউটার নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আইনি জটিলতায় পড়ে দেশে ফেরত আসতে হয়।
দীর্ঘদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকা আবদুর রহমান দেশে আসার পর অর্থসংকটে পড়েন। তবে কিছু একটা করতে চান। গতানুগতিক কোনো কাজ বা পেশায় স¤পৃক্ত না হয়ে ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা করেন। সেই চিন্তা থেকে ভ্রাম্যমান গাছ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। তার মতে গাছ মানুষের হাতে পৌঁছে দিলে সুরক্ষিত থাকবে পরিবেশ।
যা থেকে ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজ উপকৃত হবে। অনেক বৃক্ষপ্রেমীরা তার এ কর্মকে সাধুবাদ জানান। স্থানীয় বাসিন্দা চিকিৎসক পিটার রুরাম বলেন, বৃক্ষকে ভালোবাসি। তবে সচরাচর ভালো মানের গাছের চারা পাওয়া যায় না। কিন্তু আবদুর রহমান এই পেশায় আসার পর প্রায়ই গাছ ক্রয়ের সুযোগ হয়। তার কর্মকে স্যালুট জানাই। স্থানীয় বাসিন্দা জুবের আহমদ হান্নান বলেন, সিজনে বাজারে এনে অনেকে গাছ বিক্রি করেন। কিন্তু আবদুর রহমানের সাথে পার্থক্য হলো তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের হাতে গাছ পৌঁছে দেন।
তখন কোনো গাছের চারা অবিক্রীত থাকলে তা কোনো না কোনো বাজারে বিক্রি করেই বাড়ি ফিরেন। ব্যবসায়ী বাবুল আহমদ ও লিটন আহমদসহ অনেকেই তাকে বৃক্ষবন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
মায়ের দোয়া নিয়ে প্রতিদিনের কর্মতৎপরতা শুরু হয় আবদুর রহমানের। জরাজীর্ণ বাইসাইকেলে পেছনের সিটে একটি ঝুঁড়ির মধ্যে শখানেক চারা গাছ বেঁধেই শুরু হয় অবিরাম পথচলা। ঝড়-বৃষ্টি-তাপদাহ এসব মাথায় নিয়েই প্রতিদিন ছুটে চলেন মানুষের কাছে গাছ পৌঁছে দিতে। কুলাউড়ার বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন নার্সারী থেকে তা সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি গাছ সঠিকভাবে রোপন করতে কেউ আগ্রহ দেখালে তিনি তা রোপন করে দেন। পরবর্তীতে রোপন করা গাছগুলোর পরিচর্যা ও খোঁজখবর নেন নিজে থেকেই।
পরিবারে মা আছেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। ভিটা বাদে বাড়িতে যতটুকু জায়গা রয়েছে সবখানে ইতোমধ্যে চারা রোপন করে রেখেছেন। বৃহৎ আকারে একটি গাছের চারা বাগান করা তাঁর স্বপ্ন। তবে সে সামর্থ্য নেই। তিলে তিলে সঞ্চয় করেও হলে লক্ষ্যে পৌঁছতে চান। সরকারি, বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ের কোন সহায়তা পেলে আবদুর রহমানের স্বপ্ন দ্রুত ডানা মেলবে।