আজ শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজিজ আহমদ সেলিম: এক অনন্য সাংবাদিকের প্রতিকৃতি

সিলেটের বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২১, ১১:৪৩ অপরাহ্ণ
আজিজ আহমদ সেলিম: এক অনন্য সাংবাদিকের প্রতিকৃতি
শেয়ার করুন/Share it

আজিজ আহমদ সেলিম। নামেই যার পরিচয়। একজন অকুতোভয় বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক। বাংলাদেশ তথা সিলেট অঞ্চলের অত্যন্ত সৎ ও নির্ভিক সাংবাদিক হিসাবে তিনি উজ্জ্বল ও খ্যাতিমান। এই অঞ্চলের সাহিত্য সাংবাদিকতার বিকাশ ও প্রসারে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। মানুষ আজিজ আহমদ সেলিম অত্যন্ত মহৎ বিনয়ী ও সজ্জন বলেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পেয়েছেন শ্রেণি পেশা নির্বিশেষে আপামর মানুষের সম্মান ও ভলোবাসা। তিনি ছিলেন একজন সংগ্রামী সাংবাদিক নেতা। একজন নিবেদিত সমাজসেবী।

জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সহকর্মীদের অধিকারের জন্য লড়েছেন আপোষহীন।

এক জীবন কাজ করেছেন বাংলা ভাষার প্রাচীন পত্রিকা সাপ্তাহিক যুগভেরীতে। যুগভেরীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় মাহবুবর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হলেও তিনি এই পত্রিকার হাল ধরেন এবং এই শীর্ষ পদ অধিকার করে নেন তার নিজের যোগ্যতায়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসস-এর সিলেটের প্রধান ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। লিখতেন কবিতা- ছড়া। সবকিছু ছাপিয়ে তার মন ছিল আকাশের মত বিশাল উদার।

সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়টা ঠিক কবে স্মরণ করতে না পারলেও লেখালেখির সূত্রে যুগভেরী থেকেই সেই সূচনা তা প্রায় নিশ্চিত। তবে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে সিলেট প্রেসক্লাবকে কেন্দ্র করে। আমরা পরস্পরের হৃদয়ের কাছাকাছি থেকে ধীরে ধীরে গভীর গহনে যাই।

আশির মধ্য ভাগ থেকে আমরা প্রেসক্লাবে সম্পৃক্ত ছিলাম নানাভাবে। বিভিন্ন কমিটিতে অনেক দিন এক সঙ্গে কাজ করার সুবাদে এই সম্পর্ক আত্মার বন্ধনে বাঁধা পড়ে। পরে প্রেসক্লাবের ১৯৯৩-৯৪ কার্যকরী কমিটিতে তিনি সাধারণ সম্পাদক ও আমি ছিলাম সহ-সাধারণ সম্পাদক। তিনি ছিলেন সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, সিলেটের সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তির পরে ২০০৭ সালে আমি দেশে যাই। এই বিভাজন আমাকে দারুন ভাবে আহত করে। প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি হারুনুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক সেক্রেটারি মহিউদ্দিন শীরু ও সাংবাদিক বশির উদ্দিন এই বিষয়ে তাদের দুঃখের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। তৎকালীন সভাপতি মুকতাবিস-উন-নূরও আমাকে ঐক্যের ব্যাপারে একটি উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ করেন। আমি সেলিম ভাই, চৌধুরী মুমতাজ আহমদ, তাপস দাস পুরকায়সহ আরো অনেকের সঙ্গে এবিষয়ে কথা বলেছিলাম। আবার অনেকের সঙ্গে সময়ের অভাবে আলাপ হয়নি। আমি দেখেছি সবাই ঐক্যে বিশ্বাস রাখেন। সকলের এবিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি রয়েছে। সকলকেই বিশেষ করে নূর ভাইকে এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক মনে হয়েছে। বিষয়টি ছিল সময় সাপেক্ষ। আমি কয়েক সপ্তাহ পর চলে আসি। যতটুকু জানি এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দুরত্ব আরো বেড়েছে। এই বিষয়টি আমার মতো আমার অনেক বন্ধুও নিশ্চয় ভাবেন বা অনুভব, উপলব্ধি করছেন।

আরও পড়ুন:  একটি আধুনিক থানার জন্মকথা

ইতিমধ্যে জল অনেক গড়িয়েছে সুরমা-কুশিয়ারায়। আমি আশা করি সিলেটের সাংবাদিক সমাজ এক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। আমাদের অনেক সিনিয়র সাংবাদিক আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছেন এখনও। আমি বিনীতভাবে সিলেটের সাংবাদিক সমাজ ও নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ জানাবো, প্লিজ আপনারা বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবুন। ভাবী কাল আপনাদের কাছে এর কৈফয়ত চাইতে পারে! এখনো সময় আছে। সময় নষ্ট না করে একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেন। মনে রাখবেন আমরা কেউ চিরদিন থাকবোনা!

সেই সময়ে আমাদের সুরমা মার্কেটের প্রায় প্রতিদিনের আড্ডায় সেলিম ভাই, গিয়াস উদ্দিন আউয়াল ও তাপস দাস পুরকায়স্হ ছিলেন নিয়মিত। মাঝে মাঝে সাংবাদিক আল আজাদ, ইখতিয়ার উদ্দিন, আহমেদ নূরসহ সিনিয়র-জুনিয়র সাংবাদিক আরো অনেক বন্ধু এই আড্ডা- আসরে যোগ দিতেন। এইসব আড্ডা আসর বসতো প্রয়াত সাংবাদিক মহিউদ্দিন শীরুর সাপ্তাহিক গ্রাম সুরমা অথবা দৈনিক ইনকিলাবের সিলেট ব্যুরো অফিসে।

আজিজ আহমদ সেলিম সিলেটে অঞ্চলের সাংবাদিকতার প্রবাদতূল্য পূরুষ সাপ্তাহিক যুগভেরী সম্পাদক জনাব আমিনুর রশীদ চৌধুরীর স্নেহভাজন থাকার কারণে তিনি রশীদ পরিবারের প্রিয় ও আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। এতে করে সেলিম ভাইয়ের সাথে এই পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে একটি সুস্পর্ক গড়ে উঠে। তাই প্রয়াত জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সেই সময়ে সিলেটে এলে রশীদ মন্জিলে ডাক পড়তো সেলিম ভাইয়ের। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী তাকে ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। তখন সবে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়েছে। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব তখন মন্ত্রী নন। অনেকটা নিরবে নিভৃতে জীবন যাপন করছেন। নির্বাচনে জিতে বিএনপি সরকার গঠন করে ক্ষমতায়।

জনাব হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সঙ্গে একদিন ঢাকায় সেলিম ভাইয়ের ফোনে কথা হয়। কথায় কথায় তিনি সেলিম ভাইকে দুঃখ করে বলেন, আগে যারা তার চারপাশে ছিল, সারাক্ষণ কারণে অকারণে ঘুরঘুর করতো এরা এখন আগের মতো তার কাছে আসতে চায়না। কোন অনুষ্ঠানে তাকে ডাকেনা কেউ। কুশলাদি জানতে চায়না। সেইসব সুবিধা ভোগীরা এখন তাকে স্মরণ করে না আর।

সেলিম ভাই মুকতাবিস-উন-নূর, মহিউদ্দিন শীরু, আব্দুস সাত্তার এবং আমাকে বিষয়টি জানালেন। তিনি আরো জানালেন জনাব চৌধুরী তাকে বলেছেন সিলেট প্রেসক্লাব যদি তাকে ডাকে, আমন্ত্রণ জানায়, তবে তিনি অবশ্যই আসবেন।

আরও পড়ুন:  শাবান মাসে যে আমলগুলো বেশী করবেন

আমরা তার সম্মানে সিলেট প্রেসক্লাবে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাকে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করি। তিনি অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং খুবই খুশি হন। সিলেটের সাংবাদিকদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল আত্মিক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে প্রথম সিলেটে এসেই পরির্দশনে এসে ছিলেন সিলেট প্রেসক্লাবে। দিয়েছিলেন ৫০ হাজার টাকা অনুদান।

মনে পড়ছে সেদিন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব সিলেটে এলেন বিমানের দিনের প্রথম ফ্লাইটে।

আমরা তাকে ওসমানী বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়ে বিমানবন্দর লাগোয়া পর্যটন মোটেলে নিয়ে আসি। তখন আংশিকভাবে চালু হয়েছে সিলেটের পর্যটন মোটেল। তিনি আমরা কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে মোটেলের রুমে বসে দীর্ঘ সময় প্রাণখুলে কথা বলেন। অনেক না বলা কথাও অকপটে শেয়ার করেন আমাদের সাথে। বলেন সে সময়ের রাজনীতির অনেক গোপন কথাও। কিভাবে বড় দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাকে কাছে টানতে চাইলেও সেই সময়ে দলগুলোর প্রভাবশালী সিলেট বলয় তাকে বাইরে রাখতে অধিক তৎপর ছিল। তাদের নামও বলেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। অবশ্য তারো অনেক পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

ঐতিসাসিক সিলেট-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই সময়ের আলোচিত ইতিহাসের অন্যন্য এসব উপাদান, নিউজের লোভনীয় তথ্য উপাত্ত আমাদের ত্যাগ করতে হয় খুবই সংগত কারণেই। এসব কোথাও কোন ভাবে প্রকাশ করা যাবেনা বলে সকলেই তাকে কথা দিয়েছিলাম।

আমাদের গৌরব আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব জনাব হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী পরবর্তীকালে আমাদের মহান জাতীয় সংসদের স্পিকারের মর্যাদা পূর্ণ পদ অলংকিত করেন। জনাব হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী আজ ইহ জগতে নেই। দেশ-জাতি এই ক্ষণজীবী প্রজ্ঞাবান কুটনীতিক ও একজন বিরল ব্যাক্তিত্বকে মনে রাখবে অনেক অনেক দিন। তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

প্রেসক্লাবের সভায়, সিদ্ধান্তে কর্মসূচীতে সকল বিষয়ে তার সঙ্গে একমত ছিলাম এমন নয়। সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে দ্বিমত ছিল, অনেক বিষয়ে মত পার্থক্য ছিল, হয়েছে- তবে মত বিরোধ হয়নি কোনদিন।

অগ্রজ সেলিম ভাইকে সব সময় সম্মান করে চলেছি। বিনিময়ে তিনি বুক ভরা স্নেহ ঢেলে দিয়েছেন একেবারে উপুড় করে, অকাতরে। হাসিমাখা মুখ ছাড়া সেলিম ভাইকে কমই দেখেছি। প্রেসক্লাবের নির্বাচনে তার সঙ্গে একই প্যানেলে কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি। বিপরীত প্যানেলে থাকলেও আমাদের সম্পর্কে এ সবের কোন প্রভাব পড়েনি কোন সময়ে।

আরও পড়ুন:  করোনা: খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন সিলেটের ধনী সাংবাদিকরা, বঞ্চিত এখনো গরীবরা

২০১৫ সালে যখন দেশে গেলাম খবর পেয়েই যোগাযোগ করেছেন। স্ত্রী সন্তানদের কুশল-মঙ্গল জানতে চেয়েছেন। একদিন ফোন দিয়ে বললেন, তোমাকে নিয়ে আমরা সবাই বসতে চাই। তখন তিনি জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি। জানালেন এ বিষয়ে চৌধুরী মুমতাজ আহমদ, সালাম মশরুর, তাপশসহ অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে। সকলে একবার আমাকে নিয়ে বসতে চান। নির্ধারিত দিনে সবাই জড়ো হলেন।

দৈনিক উত্তরপূর্ব অফিসে যেতেই সেলিম ভাই সকলকে নিয়ে ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন। একে একে তরুণ ও নবীন সংবাদকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেদিনের সকলের ভালোবাসা আর আবেগ দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ, অবিভূত ও আপ্লুত হয়েছিলাম, ভেসেছিলাম। এক সময়ের আত্মার আত্মীয়দের সঙ্গে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ আর দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডাবাজি হলো।

তিনি বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের ব্যাস্ততায় যাওয়া হয়ে উঠেনি সে যাত্রায়। আহা, সেলিম ভাই! কোভিড শুরু হওয়ার আগেও ফোনে কথা হলো। জানতে চাইলেন, কবে আসছো দেশে? সেলিম ভাই চলার পথের ভুল, ত্রুটি – বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা চাইবার সুযোগও দিলেন না! আপনি এভাবে চলে যাবেন কে জানতো? গত বছর আত্মার আত্মীয় আজিজ আহমদ সেলিমের আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদ শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। দীর্ঘ সময় এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম।

তাকে নিয়ে কিছু লিখবো। কিন্তু কি লিখবো? কেমন করে লিখবো। এর শুরুটা কি হবে? শেষটাই বা কি? গুছিয়ে আনতে পারছিলাম না কিছুতেই। আপনার সান্নিধ্যে কাটানো যৌবনের সেই সোনালী দিনগুলো নিয়ে ভাবলে আজ গর্ব অনুভব করি সেলিম ভাই। ভালো লাগে, পুলকিত হই। সিলেটে আপনার অভাব অনুভূত হতে থাকবে বহুদিন ধরে।

সেলিম ভাই আমি, আমরা এই অতিমারি একদিন অতিক্রম করব জানি! কিন্তু আপনাকে হারানোর ক্ষতি পূরণ হবেনা! আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আবারো দেশে যাবো ইনশাআল্লাহ। সবকিছু আগের মতো আছে থাকবে-কেবল আপনি নেই! ভাবতেই যেনো অন্তরটা কেমন একটা মোছড় দিয়ে উঠে! জানি পরিবারের জন্য এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সহজ নয়। প্রার্থনা করি মহান আল্লাহপাক আপনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন এবং ভাবি বাচ্চাদের শোক যেনো শক্তিতে রূপান্তর করে দেন। আমীন।

 

দৈনিক মানবজমিন এর সৌজন্যে

সিলেটের বার্তা ডেস্ক


শেয়ার করুন/Share it
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০