আজ শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শুক্রবার সূরা কাহাফ তেলাওয়াতের রহস্য

সিলেটের বার্তা ডেস্ক
প্রকাশিত অক্টোবর ৮, ২০২১, ১২:৫৯ অপরাহ্ণ
শুক্রবার সূরা কাহাফ তেলাওয়াতের রহস্য
শেয়ার করুন/Share it

পবিত্র কোরআনের ১৮ তম সূরা হলো সূরা আল কাহফ। ১১০ আয়াত বিশিষ্ট এই সূরাটি বিবিধ কারণে বিশ্বাসীদের জন্যঅতীব গুরুত্বপূর্ণ।

 সূরায় আলোচিত আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিকতথ্যাদি এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি এই গুরুত্বের জানান দেয়। আজকের এ নিবন্ধে ইনশাআল্লাহ সংশ্লিষ্ট কতেক বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হবে।

এক. আমাদের প্রিয়নবী (সা.) একাধিক হাদিসে এই সূরার ফজিলত বর্ণনা করেছেন। আবুদ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত (ভিন্ন বর্ণনামতে, শেষ দশ আয়াত) মুখস্থ করবে সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম: ১৭৬৬) এ হাদিসে সাধারণভাবে সূরা কাহফের একটি নির্ধারিত পরিমাণ আয়াত মুখস্থ ও তেলাওয়াত করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘প্রথম’ ও ‘শেষ’ দুটি শব্দই বিবৃত হয়েছে। এজন্য কোনো কোনো হাদিসবিদের বক্তব্য হলো, সূরার শুরু ও শেষ উভয় দিক থেকে দশ দশ আয়াত মুখস্থ করে নেয়াটাই সতর্কতা। অন্যদিকে আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জুমাবার সূরা কাহফ তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তির জন্য এই জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত বিশেষ এক নূর (হেদায়ত ও নিরাপত্তার আলো) দান করবেন।’ (মুসতাদরাকে হাকিম: ২/৩৯৯) উল্লেখ্য যে, এই মর্মে একাধিক সূত্রে হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণনা পাওয়া যায়। কোনো কোনো বর্ণনার সনদ বা বর্ণনাসূত্র নিয়ে কথা থাকলেও সামগ্রিক বিবেচনায় হাদিস বিশারদগণ এসব হাদিস বিশুদ্ধ, নির্ভরযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে মত ব্যক্ত করেছেন। বস্তুত এই হাদিস থেকে বিশেষত জুমাবার সূরা কাহফ তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত প্রমাণিত হচ্ছে।

দুই. এবিষয়ক হাদিসগুলো সামনে রেখে যুগযুগ ধরে মুসলিমউম্মাহ প্রতি শুক্রবার সূরা কাহফ তেলাওয়াতের আমল করে আসছে। সাহাবা ও তাবেয়িন থেকে শুরু করে আমাদের মহানপূর্বসূরি মনীষীদের জীবনীতে এ সম্পর্কিত রকমারি তথ্যপাওয়া যায়। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) প্রতি শুক্রবারসূরা কাহফ তেলাওয়াত করতেন। কখনও ঘরে তেলাওয়াতকরতে না পারলে মসজিদে যাওয়ার পথে পড়ে নিতেন। (আলমুগনি; ইবনে কুদামা, ২/৬১০) বর্তমান সময়ে আমরা যাতায়াতের পথে ল্যাপটপ, ট্যাবলেট কিংবা মোবাইল থেকেওতেলাওয়াত করে নিতে পারি। নিকট অতীতের বিশ্ববিখ্যাতইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবি (রহ.) নিজের সম্বন্ধে বলেন, আমাদের পারিবারিক ধর্মীয়অনুশীলনের গৌরবময় ঐতিহ্যের বদৌলতে ছোটবেলা থেকেইপ্রতি জুমাবার সূরা কাহফ তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে উঠে। (দিরাসাতুন কোরআনিয়াহ; নদবি, পৃ. ১৪৮, দারু ইবনে কাসির, দামেস্ক) হজরত নদবি (রহ.) পরবর্তী সময়ে এই সূরা নিয়ে বিশেষ চিন্তা ও গবেষণার প্রয়াস পান। তাফসির, হাদিস ও ইতিহাস বিষয়ক প্রচুর গ্রন্থ অধ্যয়নের সারনির্যাস এবং নিজেরগবেষণার ফলাফল স্বরূপ তিনি এ সম্পর্কে ‘তাআম্মুলাত ফি সূরাতিল কাহফ’ নামে চমৎকার একটি বই রচনা করেন। বইটি মিসর থেকে প্রকাশিত হয় এবং বিদ্বানমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। দুর্লভ ব্যাপার হলো, রমজানের যেই জুমাবারহজরত নদবি (রহ.) এর ইন্তেকাল হয় সেইদিনও তিনি রীতিমতো জুমার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং সূরা কাহফতেলাওয়াত করতে বসেন। কিন্তু দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা হেতু সূরা কাহফ এর স্থলে সূরা ইয়াসিন সামনে চলে আসে। তিনি সূরা ইয়াসিন পড়তে শুরু করেন এবং পড়তে পড়তে এই আয়াতে এসে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন: “আপনি কেবলতাদেরকেই সতর্ক করতে পারেন, যারা উপদেশ অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখে ভয় করে। অতএব আপনি তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দিন ক্ষমা ও সম্মানজনকপুরস্কারের।” (সূরা ইয়াসিন: ১১)

আরও পড়ুন:  ফ্রান্সের ম্যাগাজিনে মহানবী (সা.) কে অবমাননা, হ্যাশ ট্যাগে বয়কট ফ্রান্স

তিন. প্রশ্ন আসতে পারে যে, এই সূরার সঙ্গে দাজ্জালের ফিতনার কী যোগসূত্র যে, এটি পাঠ করলে নিরাপদ থাকা যাবে? বিষয়টি বোঝতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পবিত্র কোরআনের এই সূরায় আল্লাহ তাআলা ৪টি ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

১. আসহাবে কাহফের ঘটনা। এটি ওই সাত যুবকের ঘটনা; যারা এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন এবং শিরক থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিলেন। তাদের দেশেরবাদশাহ ও সাধারণ লোকজন মূর্তি পূজা করত এবং অন্যদেরউৎসাহিত করত। এমন নাজুক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সেই ৭ যুবক নিজেদের দ্বীন ও ঈমান রক্ষার্থে আল্লাহর একত্ববাদ বুকে ধারণ করে দেশ ত্যাগ করেন এবং একটি গুহায় আশ্রয় নেন। আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর দয়া করেন, তাদেরকে সাহায্যকরেন এবং সূর্য থেকে রক্ষা করেন। একটি নির্দিষ্ট সময় পরআল্লাহর হুকুমে তারা পুনরায় ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং শহরের লোকজনকে ঈমানদার হিসেবে দেখতে পান। বস্তুতএটি ছিল ঈমানের পরীক্ষা।

২. বাগানওয়ালার ঘটনা। আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ দুটি বাগান দান করেছিলেন। কিন্তু লোকটি সময়েরব্যবধানে আল্লাহর শুকর আদায় থেকে বিরত থাকে এবং নিজেকে অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করে। এমনকি মৃত্যুপরবর্তী জীবননিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। লোকটিকে তার একজন বন্ধু নসিহতকরলেও সে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি। ফলে আল্লাহ তাআলা তার বাগানদ্বয় ধ্বংস করে দেন। বস্তুত এটি ছিল ধন-সম্পদের পরীক্ষা।

৩. নবী মুসা (আ.) ও খিজির (আ.) এর ভ্রমণ। হজরত মুসা (আ.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘এই পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞানী কে?’ প্রতি উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি।’ কিন্তু আল্লাহতাআলা মুসা (আ.) কে জানিয়ে দিলেন যে, অমুক জায়গায়তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী একজন ব্যক্তি রয়েছেন। অতঃপরমুসা (আ.) খিজির (আ.) এর সঙ্গে ভ্রমণ করলেন। তিনি শিখলেন যে, যেসব বিষয়কে আমরা অন্য চোখে দেখি আল্লাহরইচ্ছায় সেখানেও ঐশীজ্ঞান লুকায়িত থাকতে পারে। বস্তুত এটা ছিল জ্ঞান দানের মাধ্যমে পরীক্ষা।

৪. জুলকারনাইন এর কাহিনী। জুলকারনাইন একজন বিশ্বাসী বাদশাহ ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাকে জ্ঞান ও ক্ষমতা দানকরেছিলেন। মানুষকে সাহায্য করা এবং কল্যাণ ছড়িয়ে দেয়ারঅভিপ্রায় নিয়ে তিনি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত পুরো দুনিয়াজোড়া অভিযান চালিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলারঅনুগ্রহে তিনি তামা ও লোহার মিশ্রণে এক সুবিশাল প্রাচীরতৈরির মাধ্যমে ইয়াজুজ-মাজুজ এর সমস্যা সমাধানে সমর্থহয়েছিলেন। বস্তুত তা ছিল শক্তি ও ক্ষমতার পরীক্ষা।

এবার আসা যাক, তাহলে এই চারটি ঘটনার সঙ্গে দাজ্জালেরসম্পর্ক বা সামঞ্জস্যতা কোথায়? তাফসিরবিদ আলেমগণ বলেন, মূলত কিয়ামতের পূর্বমুহূর্তে দাজ্জালও এরকম ৪টি পরীক্ষা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে:
১. সে লোকদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে তার উপাসনা করতে আহ্বান করবে। তা হবে ঈমান ও বিশ্বাসের পরীক্ষা।
২. দাজ্জালকে বৃষ্টি বর্ষণ ও বন্ধের ক্ষমতা প্রদান করা হবে। আর সে তার সম্পদ দ্বারা মানুষকে প্রলোভিত করবে। তা হবে সম্পদের পরীক্ষা।
৩. দাজ্জাল আশ্চর্য সব খবর দিবে এবং জ্ঞানের কথা বলে মানুষকে প্রতারিত করবে। তা হবে জ্ঞানের পরীক্ষা।
৪. দাজ্জাল পৃথিবীর অনেক অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তারক্ষমতার দাপট দেখাব। তা হবে ক্ষমতার পরীক্ষা।

চার. চিন্তাবিদ আলেমগণ বলেন, দাজ্জালের ওই কঠিন ফিতনা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এবং ওইসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে যেসব উপায়-উপকরণের প্রয়োজন; আল্লাহ তাআলা সূরা কাহফে সেগুলো বলে দিয়েছেন:

ক. সৎ মানুষের সাহচর্য গ্রহণ করা। “আপনি নিজেকে তাদেরসংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদেরপালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্য কলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তারঅনুগত্য করবেন না।” (সূরা কাহফ: ২৮)
খ. দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত থাকা। “তাদের কাছে পার্থিব জীবনের উপমা বর্ণনা করুন। তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে নাজিল করি। অতঃপর এর সংমিশ্রণে শ্যামলসবুজ ভূমিজ লতা-পাতা নির্গত হয়; অতঃপর তা এমন শুস্ক চুর্ণ-বিচুর্ণ হয় যে, বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহ এ সবকিছুর ওপরশক্তিমান।” (সূরা কাহফ: ৪৫)
গ. ইবাদতে আন্তরিক হওয়া। “বলুন, আমি ও তোমাদের মতইএকজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদেরমাবুদই একমাত্র মাবুদ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তারসাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তারপালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।” (সূরা কাহফ: ১১০)
ঘ. একমাত্র আল্লাহর নিকট চাওয়া। “আপনার প্রতি আপনার পালনকর্তার যে কিতাব প্রত্যাদিষ্ট করা হয়েছে তা পাঠ করুন। তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নাই। তাঁকে ব্যতীত আপনি কখনই কোনো আশ্রয়স্থল পাবেন না।” (সূরা কাহফ: ২৭)
ঙ. পরকালের কথা স্মরণ রাখা। “যেদিন আমি পর্বতসমূহকে পরিচালনা করব এবং আপনি পৃথিবীকে দেখবেন একটি উম্মুক্ত প্রান্তর এবং আমি মানুষকে একত্রিত করব অতঃপর তাদের কাউকে ছাড়ব না। তারা আপনার পালনকর্তার সামনে পেশ হবে সারিবদ্ধভাবে এবং বলা হবে, তোমরা আমার কাছে এসে গেছ যেমন তোমাদেরকে প্রথম বার সৃষ্টি করেছিলাম। না, তোমরা তো বলতে যে, আমি তোমাদের জন্যে কোন প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করব না। আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে, হায় আফসোস! এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোটবড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি- সবই এতে রয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারও প্রতি জুলুম করবেন না।” (সূরা কাহফ: ৪৭-৪৯)

আরও পড়ুন:  পীরপুর গ্রামবাসীর উদ্যোগে তাফসীরুল কোরআন মাহফিল সম্পন্ন

লেখক: আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন।

সিলেটের বার্তা ডেস্ক


শেয়ার করুন/Share it
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১